খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় অভিমুখী নয়টিলা মাজার সংলগ্ন সবুজ প্রকৃতির পাহাড়ের অববাহিকায় একটি হোটেলে দুপুরে খেতে বসলাম। প্রখর রৌদ্রে সবুজ পাতা চিকচিক করছে। বুনোপাখি কিচকিচ করছে। ঝোঁপে রকমারি রঙের প্রজাপতি পাঁখা ঝাপটায়, এবং মাকড়শারা সুনিপুণ জাল বুঁনে ফাঁদ পেতেছে খাবারের অপেক্ষায়। দুঃখিনী নারীর কান্নার আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মাজারজুড়ে। আযানের স্পন্দনে বনের পাখিরা দিকভ্রান্তভাবে ছুটে চলে এদিক-ওদিক। মসজিদে মিলাদের খিচুড়ি খেতে সারিবদ্ধভাবে বসেছে মুসল্লী ভক্তি করে। এ যেন আপন রূহ্য়ের সন্তুষ্টি নয়, প্রভুকে সন্তুষ্টি। বিনিময়ে যেন করেন পূরণ সকল বাসনা।

মাটির চুলায় লাকড়ী দিয়ে পাঁক চলছে হোটেলে। টিনের ছাউনি দোকানটির তাকে কিছু বিস্কুট, রশিতে কিছু চিপস ঝুলছে। টেবিলে চায়ের কতগুলো কাপ ও দুধ-চিনি, এবং মাথার উপর টেলিভিশন চলছে। দোকানদার লম্বা একটা ছেঁনি নিয়ে মাঝেমাঝে লাকড়ী কেঁটে চুলায় দিচ্ছে। স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা দোকানদার পান চিবায়। সে শব্দ চয়ন করতে পারেনা, অর্থাৎ বোবা। তার নাম ফোরকান। চা’য়ে চিনি কম দিতে বললে সে বুঝতেছিলনা, ইশারায় বুঝাতে হল। তার মানে সে তার শ্রবণ ইন্দ্রিয়ও অকার্যকর।

সুন্দর একজন পাহাড়ি আদিবাসী মহিলা খাবার দিচ্ছে কাস্টমারকে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যে যেন তাতে মিশেছে। দোকানে বিচরণ করা মৌরগের চপলতা আর এ রমনীর মাঝে তফাৎ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আজকে দুপুরের ম্যানু ডিম-সবজি। ভাত নরম হয়ে গেছে তাই বারবার ক্ষমা চাচ্ছে সে। হোটেলের প্রায় সব কাজই সে করছে। সে ফোরকানের প্রথম স্ত্রী, নাম জুলেখা। তারা স্বপরিবার মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। চিরবৈরী দুমেরু মিলিত হয়েছে একইবৃন্তে। বারুদ শক্তিতে ফোরকান প্রজ্জ্বলিত হয় জুলেখার বন্ধনে রিফিউজি লতার মত। সাধারনতঃ চাকমা নারীরা চিকন-চাকন হয়, মুলিবাঁশের মত দৃড় হয়। কিন্তু ফোরকানের স্ত্রী একটু নাদুস-নুদুস কাঁশফুলের মত ও লম্বা-ফর্সা সে সেগুন গাছের মত। ক্ষুধার্ত শ্রমিক ভাতমাখা আঙুল চোঁষে এবং কাঠবিড়ালির মত একফলক টেলিভিশন দেখে আর আঁড়চোখে তাকে দেখে। সরল জুলেখা টাকার হিসাব বুঁঝেনা। কাস্টমার হিসেব করে টাকা দিয়ে যায়। জীবনের লাভ-ক্ষতির হিসাবও কষা হয়না, তাই সে এই অরন্যের অন্যতম সুখী নারী।

জুলেখা একজন কাস্টমারের সাথে কথা বলতেই ফোরকান হঠাৎ হাউমাউ করে রেগে অঙ্গার। কাজ ফেলে কেন সে বসে আছে -তার রাগের কারণ। জুলেখা ভীতসন্ত্রস্ত মুখে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে কাজ করতে লাগল। আনাড়ি ফোরকানের পৌরষদ্বীপ্তি জুলাখার স্বক্ষমতাকে ম্লান করে। মাসভর সব অর্জিত অর্থ নিয়ে সে অন্য স্ত্রীর কাছে চলে যায়। আবার সে ফিরে আসে জুলেখার বাহুডোরে। তাদের এমন অতিপ্রাকৃতিক শক্তিবলে শত মাইল দুর থেকেও ফোরকানরা সুখের নোঙর তুলে। তবুও ফোরকানরা তাদের জ্বালাতন করে জীবনভর। এভাবে হাজারো জুলেখার জীবন পরাহত হয় ফোরকানের মত হাজারো স্বামীর পৌরুষাচিক অহংবোধ্যতায়।